জান্নাতুল ফেরদৌস:
কুটিরশিল্প একদিন বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় গৌরব ছিল।যখন কলকারখানা তৈরি হয়নি বা ভারী যন্ত্রপাতি ছিল না তখন কুটিরশিল্পই আমাদের জাতীয় জীবনের নানা অভাব দূর করত।প্রাচীনকালে এ শিল্প বিশ্ববিশ্রুত মর্যাদা লাভ করলেও বর্তমানের ইতিহাসে তা ধূসরতায় হারিয়ে গেছে।
কুটিরশিল্প বলতে বোঝায় পরিবারভিত্তিক বা পরিবারের ক্ষুদ্রাকার ও সামান্য মূলধনবিশিষ্ট শিল্প -কারখানা যার উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রধানত স্থানীয় কাঁচামাল এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কারিগরি দক্ষতা ও সহজ দেশজ প্রযুক্তিনির্ভর দ্রব্যাদি।এটি গ্রাম ও শহর উভয় এলাকাতেই রয়েছে।বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন ও তত্ত্বাবধানের নিমিত্তে স্থাপিত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা।
কুটির শিল্পে অল্প খরচে দ্রব্য উৎপাদন করা যায় এবং পু্ঁজিও কম লাগে।তবে খরচ কম বলে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যও কম।এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এতে শিল্পপ্রতিভার ছাপ মেলে।দেখতে সুন্দর এবং টেকসই।বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা ১৯৮১ সালে একটি জরিপ চালায়।যাতে দেখা যায়, শিল্পের শ্রেনীকরণ পদ্ধতির আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩,২২,০০০ টি কুটির শিল্প ৮ টি শ্রেনিতে বিভক্ত,১৬০ রকমের সামগ্রী উৎপাদনে নিয়োজিত।
প্রথম শ্রেণীর (খাদ্য,পানিয়,তামাক শিল্প) অন্তর্ভুক্ত কুটির শিল্পগুলোর ম ধ্যে দুগ্ধজাত খাদ্যশিল্প,আইসক্রিম,ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও টিনের কৌটায় সংরক্ষন,মৎস প্রক্রিয়াজাত ও টিনজাতকরণ,বিভিন্ন রকম ডাল ভাঙার জাঁতা,ময়দার কল, ধান কল,তেলের কল,রুটি,বিস্কুট, গুড় ইত্যাদি তৈরির কারখানা, পানীয়, চুরুট ও বিড়ির কারখানা উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় শ্রেনীর (বস্ত্র ও চামড়া) শিল্পগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সুতা ও সুতি বস্ত্র,রেশম,তাঁত,সূচিশিল্প,গেঞ্জি,মোজা,পশমি কাপড়,পাটকাঠির সামগ্রী, দড়ি তৈরি, জাল বোনা,লেপ,টুপি তৈরি,নকশা চিত্রকরণ,জামদানি শিল্প ইত্যাদি। অপরদিকে নৌকা,খেলনা,খাট,বেত ও বাঁশের দ্রব্যাদি,বাদ্যযন্ত্র তৈরি, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তৈরি ইত্যাদি তৃতীয় শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত।
১৯৯৯-২০০০ বছরে মোট ৪০৮৫ শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাতে নিবন্ধীকৃত হয় এবং এগুলোর মধ্যে ৩২৪০ ছিল কুটির শিল্প এবং বাকি ৮৪৫ ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প।১৯৯৯-২০০০ বছরে কুটির শিল্প উদ্যোক্তা এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা উভয়ের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছিল ৫০ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা এবং এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৪২,০০৫ জন লোকের চাকরি হয়।
বৃহদায়তন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে কুটির শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।কারখানায় তৈরি পণ্য নিখুঁত হয়,কম সময়ে যন্ত্রের মাধ্যমে বেশি দ্রব্য উৎপাদন করা যায়, রুচির পরিবর্তন ইত্যাদি নানা কারণে কুটিরশিল্প তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।শীতল পাটি,তালের পাখা,মৃৎশিল্প,বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র এর অস্তিত্বকে আংশিক টিকিয়ে রাখলেও সার্বিক অবস্থা বর্তমানে ভালো নয়।কুটিরশিল্পের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্রায়তন ও বৈচিত্রময় কুটিরশিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে কারিগরদের প্রশিক্ষন দান,উৎপাদন প্রক্রিয়ার উৎকর্ষ সাধন,বাজার ব্যবস্থাপনা, মূলধন সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘকাল চর্চার অভাবে লুপ্ত হয়ে যাওয়া কারিগরি দক্ষতা, শিল্প উৎকর্ষ ও উৎপাদন নৈপুন্য ফিরিয়ে আনার জন্যে যন্ত্রপাতি, উৎকৃষ্ট কাঁচামাল,শৈল্পিক দক্ষতা ও মূলধন সরবরাহের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।এভাবে চলতে থাকলে কুটিরশিল্পের হারানো গৌরব বহুলাংশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে শুধু কুটিরশিল্প পুনরুজ্জিবনই নয়, প্রয়োজন পণ্য বৈচিত্র্য ও উৎপাদন উৎকর্ষের সাধন।জনবহুলাংশে বেকার সমস্যা সমাধান ও লাখ লাখ দরিদ্র জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনেও এ শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।