প্রচ্ছদ / প্রচ্ছদ / ছাত্র রাজনীতি নয়, বন্ধ হোক সন্ত্রাস-অপরাজনীতি

ছাত্র রাজনীতি নয়, বন্ধ হোক সন্ত্রাস-অপরাজনীতি

 মুহিব্বুল্লাহ আল হুসাইনী:

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ছাত্র রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। বিশ শতকের শুরুর দিকে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। তবে এর আগে যে ছাত্র রাজনীতি একেবারেই ছিল না তা বলা যাবে না। তৎকালীন ইয়ং বেঙ্গল ছিল ছাত্রদেরই একটি আন্দোলন। এটি ছিল মূলত প্রচলিত নিয়মাচারের প্রতি এক ধরনের বিদ্রোহ। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী সামাজিক ও অন্যান্য ব্যাপারেও আগ্রহী ছিল, যেগুলি পরবর্তীকালে রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে প্রণোদনা জোগায়। একে একে ১৯৫২ সালের সেই মাতৃভাষা আন্দোলন, ‘৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬০ এর দশকে ৬ দফা ও ১১ দফার দাবিতে তীব্র গণআন্দোলন, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ০৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী দেশ গঠন ও ‘৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সব-ই ছিল ছাত্র রাজনীতির সোনালি ফসল। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাত-ই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ।
অথচ বর্তমান দিনে নানা ছাত্রসংগঠনের ছাত্র ও অ-ছাত্র নেতারা নিজ দল ও অন্যান্য দলের মধ্যকার কোন্দলে ছাত্রদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। গতকাল রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে তুলে নিয়ে গিয়ে ১৫ ফুট গভীর পুকুরে ফেলে দিয়েছেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী। সাঁতার জানা থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। অধ্যক্ষের দাবী, অবৈধ সুযোগ করে না দেয়ায় তারা এমনটি করেছিল (দৈনিক নয়া দিগন্ত-৩রা নভেম্বর, ২০১৯) । একজন শিক্ষাগুরুর সাথে এমন বাজে আচরণ খুবই হতাশাজনক। ইদানীংকালে এসে ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। কোনো কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে নস্যাৎ করার জন্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের ফলে জনগণের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির ভাবমূর্তি দ্রুত বিনষ্ট হতে থাকে। এসব কারণে বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে নানা মহল থেকে।
অথচ এই দাবির বিষয়ে আমার প্রশ্ন, মাথাব্যথা হলে কী ঔষধ ও মলমের পরিবর্তে আমরা মাথাই কেটে দেব? নাহ! আমাদের বুঝতে হবে যে, অপরাজনীতি বন্ধে সুস্থ্য ধারার ছাত্র রাজনীতির কোন বিকল্প নেই। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে যে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের রাজনীতি চলছে তা বন্ধ হওয়া উচিত। একটি দেশের শিক্ষাঙ্গন সেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার কারখানা আর শিক্ষকরা হলেন তার কারিগর। এই শিক্ষার্থীরাই আগামীর নেতৃত্বের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
এর আগে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠতো সবসময় স্বৈরশাসকদের আমলেই। সেই শাসকদের সময়ে অবস্থা এমন হয়েছে যেন, খুন করা যাবে তবে রাজনীতি করা যাবে না। যেমনটি হয়েছিল সেনাশাসক আইয়ুব এর আমলে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলেও এই দাবীটি ওঠেছিল (দৈনিক কালের কণ্ঠ- ২৮শে মে, ২০১৮)। মূলত এই দাবি বাস্তবায়ন এর ফলে স্বৈরশাসকরা লাভবান হবে। এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি না থাকার ফলে আলোচিত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উগ্রবাদের উত্থান ঘটার সংবাদ বহুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা আত্মঘাতিমূলক উগ্রবাদ সংশ্লিষ্ট ছাত্র রাজনীতিতে ডুকে পড়ছে। হলি আর্টিজেনের হামলায় জড়িত নিবরাস ইসলাম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন (দৈনিক কালের কণ্ঠ- ৪ঠা মার্চ,২০১৭)। এছাড়াও মু. শিবলী ও আবাবিল তারাও সবাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এসবের ফলে ছাত্র রাজনীতির গুরুত্ব আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে ।
অনেকে ছাত্র রাজনীতির ফলে ক্যাম্পাসে র‌্যাগিং নির্যাতনের কথা বলে থাকেন। অথচ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি না থাকা সত্ত্বেও অহরহর‌্যাগিং সমস্যা ঘটেই চলছে। এমনকি ২০০২ সালের জুনে ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর (সাবেকুন নাহার সনি) মৃত্যুর পরও ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি এভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এতদিনে তা বাস্তবায়ন হওয়াতো দূরের কথা, উল্টো ছাত্র লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী কর্তৃক গত মাসে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ’কে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার মতো নির্মম ঘটনা ঘটলো (দৈনিক সমকাল- ১২-ই অক্টোবর,২০১৯)। এতে প্রমাণিত হলো , শুধু ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই শৃঙ্ক্ষলা ফিরানো সম্ভব নয়। মূলত অপরাজনীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবী। পাশাপাশি কঠোর আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত এবং যথোপযুক্ত বিচার করে তাদের অপরাধের মাত্রা বুঝে সংশোধনের সুযোগ করা দরকার। ইতোমধ্যে আমরা আবরার হত্যায় জড়িত খুনীদের তাৎক্ষণিক বিচারপক্রিয়ার কাজ শুরু হতে দেখেছি। যা আমাদের আশার আলো দেখায়।
আর বর্তমানে যারা দেশ পরিচালনা করছেন, তারা কোন না কোনভাবে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতি করে আসছেন। সুভাষ বসুকে ভালবেসে বঙ্গবন্ধু শুরুর দিকে স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যা তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে বলেছেন “১৯৩৭ সালে একটু সুস্থ হয়ে, আবার লেখাপড়া শুরু করলাম। আমার আব্বা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। এই সময়ে আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এম.এস.সি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তার জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন।
গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলামন বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম। এবং এই চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতাম। ঘুরে-ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতাম। আমাকেই অনেক কাজ করতে হত মাস্টার সাহেবের সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই ‘সেবা সমিতি’র ভার নেই। এবং অনেকদিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক”। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বক্তব্য অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করা ছিল সুচিন্তিত এবং সমাজ সেবামুলক।
একসময় ১৯৬৯ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় শেখ মুজিব’কে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন তুখোড় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। এমনকি ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধু’কে জাতির জনক উপাধি দেন আসম আব্দুর রব। যিনি নিজেও ছিলেন ছাত্র রাজনীতির সিংহ পুরুষ। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনটি একটি বিতর্কিত আন্দোলন হলেও আমরা যদি মাঠের সফলতার দিকে তাকাই, তবে এর মূলেও রয়েছে ছাত্র জনতারা। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে জড়িত নেতৃবৃন্দরা অনেকে কোন না কোন সময় ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এই আন্দোলনের আলোচিত নেতা, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাবির ভিপি নুরুল হক নূর ছিলেন ঢাবির মহসিন হল শাখা ছাত্রলীগের উপ-মানব বিষয়ক সম্পাদক। (দৈনিক ইত্তেফাক- ২৯ শে মে, ২০১৯) যদিওবা অনেকে তাঁকে ইসলামী ছাত্র শিবির সংশ্লিষ্ট বলে মন্তব্য করে থাকেন। ( দৈনিক ইনকিলাব- ২৭ শে মে, ২০১৯) আর ছাত্র শিবির সংশ্লিষ্ট এই মন্তব্য ও কিন্তু দলীয় ছাত্র রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব বহন করছে। পরিশেষে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আদর্শবাদী ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবী।
লেখক,
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (বিআইইউ) ও
প্রধান সহ-সম্পাদক
সিএন নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম
লেখকের বিগত কলাম:

এছাড়াও চেক করুন

প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু টানেলে টোল দিলেন প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টোল দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *