প্রচ্ছদ / প্রচ্ছদ / অভাবের সংসার সাকি – সোহাগ

অভাবের সংসার সাকি – সোহাগ

সিএন নিউজ২৪.কম ।

তখন রাত্র সাড়ে ন’টা বাজে মাত্র। গ্রামে অনেক রাত বলা যায়। মরজিনার সারা শরীর রক্তে রাঙ্গানো। হাতে তরকারি কাটা রক্তাক্ত বটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জলিল মিয়ার বাড়ির পিছনে কলা গাছের আড়ালে। চারিদিকে হৈচৈ রটে গেছে। মানুষ ছুটে আসছে নানান দিক থেকে। কারো হাতে হ্যারিকেন, কারো হাতে মাটির প্রদীপ এই জ্বলছে এই নিভছে। মরজিনার বুকের মাঝে ধুকপুক করছে। এই বুজি কেউ দেখে ফেললো। হঠাৎ একটু শূন্য লোকালয় পেয়ে মরজিনা হাতের বটিটা ছুঁড়ে দিয়ে অন্ধকারে চেনা অচেনা পথে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো।

মরজিনার মা বিউটি বেগম জলিল মিয়ার বাড়িতে ঝির কাজ করে। কাজের ঝি হলেও সে ও বাড়ির গৃহকর্ত্রীর মতো পরিশ্রম করে। কারণ জলিল মিয়ার বউ দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। তারপর থেকে আজ প্রায় সাত বছর ধরে বিউটি বেগম জলিল মিয়ার সেই দুই সন্তানকে নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করে আসছে। জলিল মিয়ার বাড়ির পাশেই মরজিনাদের বাড়ি। মরজিনার বাবা ফয়েস আলী এপেন্ডিসাইটিসের রুগী। তার জীবন এখন মরণাপন্ন। সারাদিন বড় ঘরের বিছানায় শুয়ে থাকে। নিজ ক্ষমতায় উঠতেও পারে না, বসতেও পারে না। আহারে সোনার জীবন? যৌবনকালে কতই না কাজ কর্ম করছে। কতই না পরিশ্রম করে সাজিয়েছিল সোনার এই সংসার। তা যে আজ নিজের চোখের সামনেই ভেঙে চূড়ে চূড়মার হয়ে যাচ্ছে। কোনো দিন চিন্তাও করিনি সে একদিন এমন হবে।
এজন্য প্রত্যেক মানুষের উচিৎ তার দেহকে নিয়ে চিন্তা করা। খেয়াল করা । কল্পনা করা। অত্যন্ত সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সৃষ্টিকর্তার নিকটে শুকরিয়া পৌঁছে দেওয়া। কারণ বিধাতা তাকে ঘুম থেকে জেগে উঠার তৌফিক অপর্ণ করছে।
খবরের কাগজ দেখলেই বোঝা যাবে, সেই সকালের আলো তার মতো অনেকেই হয়তো দেখতে পারেনি। তার মতো অনেকেই হয়তো সে সকালে জেলখানায় কয়েদি হয়ে সীমাবদ্ধ আছে কোনো অন্ধকার রুমে । অনেকেই হয়তো হাসপাতালের বেডে শুয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে।
বিউটি বেগম ভোরের সেই প্রথম প্রহরেই জলিল মিয়ার বাড়িতে যায়। সকালের নাস্তা বানিয়ে ছেলে দু’টোকে খেয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে জলিল মিয়ার খাবার মেঝের পাটিতে সাজিয়ে রেখে নিজের জন্য বেচে যাওয়া খাবারটুকু নিয়ে বাড়িতে আসে। তারপর স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে খায়। আবার দুপুরে গিয়ে রান্না করে দিবে। ছেলেদের স্কুল থেকে নিয়ে আসবে, রাতে রান্না করে দিয়ে ছেলেদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চলে আসবে। বিনিময় মরজিনার মাকে প্রতিদিন বিশ টাকা ও উচ্ছিষ্ট খাবারটুকু দেওয়া হয়। যা দিয়ে একিবারেই চলে না মরজিনাদের সংসার। মরজিনার বাবার প্রতিদিন বিশ পঁচিশ টাকার ওষুধ লাগে। বলতে গেলে, খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে এই সংসারের তিনটি মানুষ।
তবে কোনো কোনো দিন জলিল মিয়া বিশ টাকার বেশিও দেয় বিউটি বেগমকে। যেদিন জলিল মিয়াকে আনন্দে রাখবে, একটু ভালোবাসা একটু আদর দিবে, শুধু সেদিনই কিছু টাকা ধরে দেয়। মরজিনার মা সহজ সরল গ্রামের মানুষ। নীরবে নির্জনে শুধু চোখের নোনা জল ছেড়ে দিয়ে নিজের মনকে বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু অবুঝ মন কিছুতেই বুঝতে চায়না যে, রুপ যৌবন মান সম্মানের চেয়ে বেঁচে থাকাটা বড়ই জরুরী। বেঁচেই যদি না থাকলাম, এই রুপ যৌবন মান সম্মান দিয়ে কী হবে? তার থেকেও বড় কথা দেয়ালে ঠেকলে পিঠ কিছুই করার থাকেনা।

বড় ঘরে ফয়েজ আলী গোঙাচ্ছে আর কাঁদোস্বরে ডাকছে-
‘ও মা গো, ও মা, আমাক একটু পানি দেও মা, ও মা, মা, ও মাগো। আমার কলিজা যে ফেটে যাচ্ছে মা।’
এমন করুণ ডাক শুনলে পাষাণ মনের মানুষেরও চোখ ভিজে যাবে। আহারে জীবন? সে ডাক যেন আজ কারো কানেই পৌঁছে না। বাড়ির উঠোন ফাঁকা। আঙ্গিনায় বসে কয়েকটা কাক কা কা করছে। বিউটি বেগম জলিন মিয়ার বাড়িতে গেছে। মরজিনা গেছে সোনা মিয়ার পুকুরে গোসল করতে। চৈত্রের এই ভর দুপুরে আকাশের মাটি ফাটা রোদ এসে পড়ছে ঘরের চালে। টিনের চাল ঘেমে একাকার। সেই সাথে ঘেমে যাচ্ছে ফয়েস আলীর আধমরা দেহখানি । ফয়েজ আলীর কান্না শুনে ঘরের দরজায় উঁকি দিচ্ছিল একটি কুকুর। ফয়েজ আলীর কান্নায় কুকুরটির চোখ দুটিও ভিজে এলো। অন্যমনস্ক হয়ে চলে গেলো কোনো একদিকে।
কাঁদতে কাঁদতে গলার কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে আসছে। মুখে আর কথা ফুটছে না প্রায়। শুয়ে থেকেই আঙ্গিনায় কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো ফয়েজ আলী। তাই কান্না জড়িত শুকনো কণ্ঠে আবারো ডাকার চেষ্টা করলো-
‘ও মা, কে মা? আমাকে একটু পানি দেও মা। আমি মরে যাচ্ছি মা।’
বাবার এমন কণ্ঠ শুনে ভেজা শরীরেই দৌড়ে গিয়ে ঢুকলো বাবার কাছে। এক মগ ঠাণ্ডা পানি আগে বাবাকে খাওয়ালো মরজিনা। আহারে পানি খাওয়ার সে দৃশ্য দেখলে মনে হয় সেটা পানি না। এক মগ জীবন। এক মগ বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই জলিল মিয়ার দু’জন ছেলে চলে আসে মরজিনার কাছে পড়তে। মরজিনা ওদেরকে প্রতিদিন এক ঘন্টা করে পড়ায়। বিনিময়ে প্রতি সপ্তাহে পঞ্চাশ টাকা পায়। লক্ষী মেয়ের মতো টাকাটা এনে মায়ের হাতে দেয়। মা তা অতি যত্নে রেখে দেয়। মেয়েটা যে বড় হচ্ছে। বিয়ে সাদিও তো দিতে হবে। এমন যুবতী মেয়ে নিয়ে আজকাল চলাচল বড়ই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ ভালো চোখে দেখে না। সবাই দুবর্লতার সুযোগ খোঁজে। এই কয়েকদিন আগে পাড়ার এক মুরুব্বী বিউটি বেগমকে প্রস্তাব রাখে-
‘তোমার মাইয়াডা তো শিয়ান হয়ছে। বিয়ে সাদি দিবা না নাকি?’
‘তা তো দিতেই হইবো।’
‘কোনো টাকা নিমুনা বুঝলে!’
‘মানে কী?’
‘সহজ কথাডা বোঝ না। আমি কি বুড়ো হয়ছি নাকি?’

মাথা নিচু করে চলে আসা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। এদিকে জলিল মিয়া তো কয়েকবার প্রস্তাবখানা দিয়েছে। যদিও জলিল মিয়াকে সম্বন্ধে চাচা ডাকে মরজিনা। একদিন তো মরজিনাকে ধরেই বসে ছিল। সপ্তাহ শেষে বিকেলে জলিল মিয়ার কাছে যায় টাকা আনতে মরজিনা।
‘চাচা আজ তো সপ্তাহ শেষ। তো আইছিলাম টাকাটা লইতে।’
‘অহন তো খুচরা নেইরে মা। তুই একটু সন্ধ্যার পরে আইস।’

সন্ধ্যার পর বিউটি বেগম জলিল মিয়ার রাতের রান্না সেরে বাড়িতে আসে। তারপর বাবার কাছে মাকে রেখে জলিল মিয়ার বাড়িতে যায় মরজিনা টাকাটা আনতে।
‘চাচা আছেন।’
‘মরজিনা আয় ঘরে আয়।’
মরজিনা ঘরে ঢুকে মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কি রে পাগলী দাঁড়াইয়া আছোস কেন? কাছে আয় পাশে একটু বস। একটু গল্প করি।’
‘না চাচা মানষে খারাপ কইবো। টাকাটা দিলে চলে যাইতাম ।

 

 

দূরও পাগলী টাকাতো দিমুই। আচ্ছা বল তোকে প্রতি সপ্তাহে কয় টাকা দেই?’
‘কেন! পঞ্চাশ।’
‘এই টাকা দিয়ে কী করস?’
‘মাকে দেই। মা টাকাটা জমায়।’
‘আচ্ছা তোকে যদি পাঁচশ টাকার একটা করে নোট দেই প্রতি সপ্তাহে। নিবি?’
‘নিমুনা কিল্লাই! নিমু।’
‘তাইলে এই নে।’
বলেই পাঁচশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় মরজিনার দিকে। মরজিনা নিতে গেলেই খোপ করে হাত ধরে জলিল মিয়া। টেনে বিছানায় বসায়। পাঁচশ টাকার বিনিময় মরজিনার সাথেও ধস্তাধস্তি করে জলিল মিয়া। এক পর্যায়ে জলিল মিয়াকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যায় মরজিনা। তারপর থেকে প্রায় কয়েক সপ্তাহ আর পড়ার টাকা আনতে যায়নি মরজিনা। মাকে দিয়ে আনিয়েছে।
হঠাৎ করেই ফয়েজ আলীর শরীরটা খুব খারাপ। হাত পা ফুলে গেছে। কথাও সেরকম একটা বলে না। চুপচাপ হয়ে শুয়ে থাকে। পাড়া প্রতিবেশী বড় ডাক্তারের কাছে নিতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু টাকা লাগবে অনেক। এত টাকা ওরা কোথায় পাবে? দিবেই বা কে? জলিল মিয়ার কাছে গিয়ে চাইলে সে সোজাসুজি বলে দিয়েছে-
‘মাইয়াডারে আমার লগে বিয়ে দাও। টাকা সব আমি দিমু।’
‘কী কও জলিল ভাই এগুলা। হেয় যে তোমার ভাতিজী সম্বন্ধে।’
‘তাতে কী।’
মুখ বন্ধ হয়ে যায় বিউটি বেগমের। ফিরে এসে স্বামীর কাছে বসে বসে শুধু কাঁদে। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। চারিদিকে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়তে শুরু করছে। পাখিরা নীরে ফিরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না বিউটি বেগম। এই রাতেই ডাক্তারের কাছে নিতে হতে। নাহলে মনে কয় না রাতটা টিকবে ফয়েজ আলী।
নিরুপায় হয়ে বিউটি বেগম আবার যায় জলিল মিয়ার কাছে। এবার জলিল মিয়া কিছু টাকা দিতে রাজি হয় । তয় শর্ত জুড়ে দিয়েছে। জলিল মিয়াকে আনন্দ দিতে হবে।
স্বামী যখন মৃত্যুশয্যায় স্ত্রী তখন জলিল মিয়ার বিছানায়। বেঁচে থাকাটা বড়ই কঠিন। শুধু একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য কতবার যে মরতে হয়েছে এই সংসারটাকে? মরতে হয়েছে এই সমাজের কাছে। মরতে হয়ছে এই সমাজের প্রভাবক্ষম মানুষ নামের জন্তুদের কাছে। আহারে আর কত? কত আর?
বাবার শরীর যখন খারাপ থেকে আরও গুরুত্বর খারাপ হতে শুরু করছে। তখন মেয়ে হয়ে কীই বা আছে করার? শুধু সান্তনা দিচ্ছে।
‘বাবা তোমার কিছুই হইবো না। মা গেছে টাকা আনতে। চলে আইবো অহন।’
ফয়েজ আলী সে সেময় হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। চোখ দুটি অপলক তাকিয়ে আছে ঘরের চালের দিকে। বারবার ডাকা স্বত্বেও কোনো সাড়া শব্দ করছে না। এতক্ষণেও যখন মা এলো না। তখন নিরুপায় হয়ে বাবাকে ঘরে রেখেই এগিয়ে যায় মরজিনা জলিল মিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঘরের দরজা খুলেই এমন একটি দৃশ্য ওর চোখে ভেসে উঠলো। যা দেখে শরীরের সব লোম শিউরে উঠলো। রক্তের চলাচল আরও বেড়ে গেল দ্বিগুণ। কিছু ভেবে উঠার আগেই মেঝেতে পড়ে থেকে ধারালো বটিটা নিয়ে জলিল মিয়ার বাঁ পায়ে এক কোপ বসিয়ে দেয়। সাথে সাথে পায়ের রগ কেটে যায়। রক্ত ফিনকী দিয়ে ছিটে আসে মরজিনার চোখে মুখে। ও মা, বলে দ্বিতীয় বার চিৎকার দেওয়ার আগেই গর্দানে বসিয়ে দেয় আরেক কোপ।

এছাড়াও চেক করুন

রাজনৈতিক মামলায় পলাতক সৈয়দ মো: ওবায়েদ উল্যাহ

ফেনী সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়নের দক্ষিন খাসেবাড়ী মোস্তাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ মো: ওবায়েদ উল্যাহ পিতার- …