মুহিব্বুল্লাহ আল হুসাইনী
আমরা জাতিগতভাবে উৎসবপ্রেমী। বছরের উল্লেখযোগ্য দিনগুলিতে মেতে ওঠি উৎসবে। বাকি নেই এতে কিশোর-যুবা কিংবা বৃদ্ধ । অনেকগুলো সময় পুরান ঢাকায় কাটানোর সুবাদে দেখেছি; এই শহরের মানুষগুলোর উৎসব যেন দিনের পর দিন লেগেই থাকে। কখনো সাকরাইনের ঘুড়ি উড়ানো উৎসব, কখনো দেখি বসন্তের হলুদ-বাসন্তি রাঙা হেঁটে চলা রাজপথ, পিঠা উৎসব, বৈশাখী মেলা, আলোকসজ্জায় সজ্জিত বিয়ে-সাদীর আয়োজন, ঈদ, পূজা-পার্বন এককথায় যে যার ধর্মমতে আয়োজন করছে। উৎসবে মেতে ওঠছে।এ যেন প্রাণোচ্ছল মাহেন্দ্রক্ষণ। নেই কোন অভিযোগ-অনুযোগ।
এদিকে চলে এলো পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ। মনে পড়ে, শৈশবে পাড়া-গাঁয়ের সমবয়সী কিশোররা মিলে পয়লা বৈশাখে বেশ মেতে ওঠতাম। গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিক্বিদিক ছুটোছুটি, আব্বুর চোখ ফাঁকি দিয়ে পাড়ায় ঘুরে-ঘুরে আনন্দ ভাগাভাগি, ভোজনবিলাসী সুখের বিহান কেটে যেতো সেই দিনগুলিতে। আহা শৈশব। এক আকাশ সমান উজাড় করা সুখ কী আর তবে মিটিবে? বাঁধভাঙা দস্যিপনার সুযোগ কী আর জুটিবে? নাহ, সময় এখনো আছে। তারুণ্য যতোদিন থাকবে উৎসবমূখর সময় ততোদিন বেশ চলবে। ইনশাআল্লাহ্।
আর হ্যাঁ! বাংলাদেশের বঙ্গীয় মুসলমানরা এই বৈশাখী উৎসব অবশ্যই উদযাপন করে আসছে এবং উদযাপন করবে। কিন্তু উদযাপনরীতি ইসলামের মৌলিকত্ব বা তৌহিদের ধারণার বিরোধী হবে না। কোনো স্থানীয় বা দেশজ সংস্কৃতির সাথে ইসলামের স্বভাবতই কোনো বিরোধ নেই, যতক্ষণ তা ইসলামের তৌহিদি ভাব ও চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক না হবে। ইসলাম মোটেও সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দেয়না। শিক্ষা দেয় সম্প্রীতি ও ভালোবাসা।
পহেলা বৈশাখকে অনেকে উদযাপন করে হিন্দু ধর্মানুসারে গণেশ দেবতার মূর্তি এবং শক্তি ও মঙ্গলের প্রতীক বিভিন্ন দেবদেবীর বাহনের মূর্তি নিয়ে যেমন- কার্তিকের বাহন ময়ূর, মা স্বরস্বতীর বাহন হাঁস, মা লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা এবং আরো বিভিন্ন রাক্ষস-খোক্ষস ও জীবজন্তুর বিশাল বিশাল মূর্তি নিয়ে মঙ্গলশোভাযাত্রা করার মাধ্যমে। অথচ এখনো আমাদের দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের গণেশপূজার সময় মঙ্গলশোভাযাত্রা হয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখে এ যেন আমাদের মুসলিম জাতিসত্তা ও আত্মচেতনার দিককে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির দিকে ঘুরিয়ে নেয়ার এক মহাযজ্ঞ! সুতরাং ‘সার্বজনীন বাঙালি উৎসব’, ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ ইত্যাদি স্লোগান হচ্ছে মন-মগজে বিজাতীয় সংস্কৃতি ও পৌত্তলিকতার চর্চার বীজ ঢুকিয়ে বস্তুতপক্ষে এদেশের গণমানুষের তৌহিদি ভাব ও চেতনা এবং ইসলামের প্রভাবকে সঙ্কুচিত করার দুরভিসন্ধির নামান্তর মাত্র।
পহেলা বৈশাখের সময়কার মঙ্গলশোভাযাত্রাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য বলা ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; কেননা বিগত ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে ক্ষমতা ও মঙ্গলের প্রতীক হিন্দুদের পৌরাণিক দেবদেবীদের বাহনের মূর্তি নিয়ে এবং বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের উদ্ভট মুখোশ পরে মঙ্গলশোভাযাত্রার মাধ্যমে ব্যাপক ঢোলবাদ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়।
যতটুকু জানি, অতীতে এই আড়ম্বরপূর্ণ ও ঘটা করে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়নি। বরং তখন এই উৎসবের দিনে পুরো বছরের দেনা-পাওনার হিসাব, খাজনা আদায় করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু মহাজন ও জমিদাররা নিজেদের প্রজাদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করতো, যা ‘পুণ্যাহ’ নামক একটি অনুষ্ঠান ছিল। নতুন বছরের জন্য হালখাতা খোলা হতো। অথচ এখন এসবের চেয়েও বিকৃত উদযাপনের প্রভাব দেখা দিয়েছে।
এছাড়া বিশেষত শহুরে মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। গরিব-দুখীদের নিত্যই পান্তাভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে জনসাধারণের কাজ-কর্ম বন্ধ। আয়-রোজগারের পথ রূদ্ধ। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের যেখানে কষ্টের সীমা নেই । সেখানে বৈশাখের সাথে এসব ব্যয়বহুল খাবারের কোন সম্পর্ক নেই। সচ্ছল মধ্যবিত্তদের উচ্চবিত্তদের একদিনের জন্য পান্তাভাত খেয়ে ‘বাঙালি’ হওয়া কীভাবে সার্বজনীনতার পরিচায়ক হয় আমার বুঝে আসেনা।
ইসলাম আধুনিক সভ্যতার সু-অভিজ্ঞতাগুলোকে উপেক্ষা করে না। এমনকি আধুনিক সভ্যতার যেসব মেগা প্রকল্প নিয়ে পশ্চিমারা কাজ করে থাকে, সেসবেও ইসলাম তার নিজস্ব ফাংশন নিয়ে হাজির হতে চায়, তবে তৌহিদি চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। এজন্যই বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এত অধপতনের পরও ইসলাম টিকে আছে স্বমহিমায়, শুধুমাত্র তার নিখুঁত তৌহিদি আদর্শের জোরেই। এখানে প্রসঙ্গত ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। এই দেশে আগত মুসলিম শাসক ও পীর-আউলিয়াগণ ইসলামের সুমহান সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রসারের মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষ জাত-বংশ বিরোধে নির্যাতিত ও শোষিত হিন্দু সমাজকে যে মুক্তির দিশা দিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। সেই ইতিহাসকে বরাবর আড়াল করার কসরত করা হয় কথিত ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র নামে।
আমাদের হাজার বছর আগের পূর্বপুরুষ ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং তাদের যাবতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব, কৃষ্টি ও জীবনাচার ছিল হিন্দু সনাতনী ভাবধারার। জাতপাতের বিভেদে জর্জরিত সেই সনাতনী হিন্দু সমাজে এলিট হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা হিন্দু চাষাভূষা ও গরিব প্রজাদের ওপর নির্মম শোষণ ও অত্যাচার চালাতো; কিন্তু বাংলায় পীর-আউলিয়াদের আগমনে সেই শোষিত ও দলিত শ্রেণির হিন্দুরা জাহেলি বৈষম্য ও জমিদার-মহাজনদের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে ইসলামের মহান ও সাম্যের ছায়াতলে এসে মুক্তির আশা করতে পেরেছিল। এভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিম হয়েছিলেন।
আজ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি সেই মুসলিম। আর তাদের প্রতিটি কাজ হলো ইসলামি দ্বীনকে কেন্দ্র করে। দ্বীন হতে বিচ্যুত হয়ে নয়। বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির উর্ধ্বে গিয়ে গড়ে ওঠুক সুখের সমাজ। কাটুক প্রতিটি সুন্দর মুহূর্ত। করোনা মহামারি হতে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন ফিরে আসুক আমাদের মাঝে। এই কামনা করছি প্রভুর দরবারে। শুভ বাংলা নববর্ষ-১৪২৭। শুভ হোক আগামীর দিনগুলি।
মুহিব্বুল্লাহ আল-হুসাইনী।
প্রধান সহ-সম্পাদক
সিএন নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
CNNEWS24.COM সত্যের সন্ধানে সবার সাথে মিলে মিশে