“আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক”
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!”
যদি বলা হয় আমাকে তোমার প্রিয় কবি কে? আমি সাচ্ছন্দ্যে যার নাম বলবো তিনি হলেন জীবনানন্দ দাশ। সেই জীবনানন্দ দাশের আজ ১২২ তম জন্মদিন।
কবি জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও সমাজ সেবক । তিনি ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। মাতা কুসুম কুমারী ছিল একজন বিখ্যাত কবি। জীবনানন্দ দাশের বাল্য শিক্ষার সূত্রপাত হয় মায়ের কাছেই। তারপর তিনি বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৫ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ প্রথম বিভাগে এবং ১৯১৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ১৯২২ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। জীবনানন্দ দাস ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছু আগে তিনি স্বপরিবারে কলকাতায় চলে যান।
ছাত্রাবস্থায় থাকা অবস্থায় তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ ব্যহ্মবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬ খ্রি:), বনলতা সেন (১৯৪২ খ্রি:), মহাপৃথিবী (১৯৪৪ খ্রি:), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮ খ্রি:), রূপসী বাংলা (১৯৫৭ খ্রি:), বেলা অবেলা কার বেলা (১৯৬১ খ্রি:)। এছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মাল্যবান (১৯৭৩ খ্রি.), সুতীর্থ (১৯৭৭ খ্রি.) জলপাইহাটি (১৯৮৫ খ্রি.) জীবন প্রণালী (অপ্রকাশিত), রাসমতির উপাখ্যান (অপ্রকাশিত) ইত্যাদি। তার রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। কবিতার কথা (১৯৫৫ খ্রি.) নামে তার একটি মননশীল ও নন্দন ভাবনা মূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ আছে। সম্প্রতি কলকাতা থেকে তার গদ্য রচনা ও অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন রূপে ‘জীবনানন্দ সমগ্র’ (১৯৮৫ খ্রি:) নামে বারো খ- রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে।
কবিকে নিয়ে সাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন–
“বঙ্কিমচন্দ্র কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশাপাশি দেখলে রবীন্দ্রনাথকে ঔপন্যাসিক হিসেবে অত্যন্ত নিষ্প্রভ লাগে। তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণেরও তদবস্থা। আর কবি হিসেবে জীবনানন্দ যে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক অনেক গুণে গুণী– ঢের বেশি ঈশ্বরপ্রেরিত
বুদ্ধিমান –সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না।”
অনেক সাহিত্যিক সমালোচকের মতে জীবনানন্দ বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি।
১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর হিমশীতল রাত, নিউমোনিয়াকে সঙ্গী করে নিঃসঙ্গতার কবি পৃথিবীর ব্যস্ততা থেকে অবসর নিলেন। হয়তো কবি আবার ফিরে আসবেন তার ধানসিঁড়িটির তীরে, হয়তো মানুষ হয়ে নয় হয়তো শংখচিল শালিখের বেশে। তবে দৃশ্যমান পৃথিবীর ক্লান্তি থেকে জীবন ভরে ছুটি নিয়ে চলে গেলেন কবি।
“আর তো ক্লান্তি নাই—নাইকো চেষ্টা আজ—নাইকো রক্ত ব্যথা—বিমূঢ় ভিড়ের থেকে নিয়েছি জীবন ভরে ছুটি”
হেঁটেছি অনেক পথ—আমার ফুরালো পথ—এখানে সকল পথ তোমার পায়ের পথে গিয়েছে নীলাভ ঘাসে মুছে।”
বিশ শতকের অন্য কোনো বাঙালি কবি আমাদের কল্পনায় এমন প্রবলভাবে দাগ কাটেনি। আজও তার কবিতার অলঙ্কার শব্দ ব্যবহার এবং অধুনা আবিষ্কৃত গদ্যের ভাষা আমাদের ক্রমেই বিস্মিত করে চলেছে। জীবনানন্দের মৃত্যুর ৬১ বছর পরও তিনি সমকালীন বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রধান কবি হিসেবে আজও অধিষ্ঠিত।
তথ্যসূত্র :
১. জীবনানন্দ : গোপাল চন্দ্র রায়
(প্রকাশ কাল ১৯৭১ খ্রি:)
২. জীবনানন্দ দাশ : রোখসানা চৌধুরী
সাজেদুর আবেদিন শান্ত
লেখক ও সম্পাদক
উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকী
ইমেইলঃ mdsantosazedur@gmail.com
CNNEWS24.COM সত্যের সন্ধানে সবার সাথে মিলে মিশে